গ্রাফিক্স: অরিত্র দেব।
শোভিক মুখোপাধ্যায়: নির্বাচন যে কোনও গণতান্ত্রিক দেশের অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা বজায় রাখতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। ভারতও এর ব্যতিক্রম নয়। নির্বাচন এবং অর্থনৈতিক গতিবিধির মধ্যে জটিল পারস্পরিক সম্পর্ক রাজনৈতিক তথা প্রশাসনিক নীতি নির্ধারণকে যেমন ত্বরান্বিত করে, বিনিয়োগকারীদের মনোভাবকেও প্রভাবিত করতে পারে।
২০২৪ সালের লোকসভা নির্বাচন প্রায় আসন্ন। এখনও অবধি রাজনৈতিক দলগুলির নির্বাচনী প্রচার বাবদ অর্থ ব্যয়ের কোনও তথ্য নেই। তাই এক্ষেত্রে আলোচনার আধার ২০১৯ সালের সাধারণ নির্বাচনে অর্থ ব্যয়ের তথ্য নির্ভর। কেমন সেই অঙ্ক? টাইমস অফ ইন্ডিয়ার ২০২১ সালের একটি প্রতিবেদন জানাচ্ছে, বিজেপি ২০১৯-এর লোকসভা ও অন্ধ্রপ্রদেশ, ওড়িশা, সিকিম ও অরুণাচল প্রদেশের বিধানসভা নির্বাচন বাবদ এক হাজার দুশো কোটি টাকা ব্যয় করেছে বলে নির্বাচন কমিশনকে জানিয়েছে৷ তার মধ্যে ১৭৫ কোটি খরচ করা হয়েছে তারকা প্রচারকারীদের পিছনে, ৩২৫ কোটি মিডিয়া বিজ্ঞাপনে, ২৫ কোটি পোস্টার, ব্যানার, কাট আউটে, প্রায় ১৬ কোটি জনসভায় এবং প্রায় ২১৩ কোটি অন্যান্য ক্ষেত্রে। এছাড়াও রয়েছে আনুষঙ্গিক বিবিধ ব্যয় ৷
সি.এম.এস-এর ২০১৯ সালের একটি রিপোর্টে বলা হয়েছে, ২০১৯ সালের নিরিখে ২০২৪ সালে সমস্ত রাজনৈতিক দলগুলির সম্মিলিত নির্বাচনী প্রচারের খরচ বেড়ে প্রায় আনুমানিক ১ লক্ষ কোটি টাকায় পৌঁছবে- প্রতি ভোটার পিছু ব্যয় ২৭ টাকা৷ এই রিপোর্ট ঠিক না ভুল এবিষয়ে মতামত প্রদান সম্পূর্ণভাবে ব্যক্তিসাপেক্ষ। স্বাভাবিকভাবে নির্বাচন কমিশনে রাজনৈতিক দলগুলি যে হিসাব দিয়েছে, সেটাই চূড়ান্ত৷ সেখানে বিজেপি ১ হাজার দুশো কোটি ও কংগ্রেস ৮২০ কোটির হিসাব দিয়েছে৷ অর্থাৎ দুটি প্রধান দল মিলে ২ হাজার কোটি টাকা খরচ করেছে৷ সেই অঙ্কটাও নেহাৎ কম নয়৷ এর পাশাপাশি অন্যান্য রাজনৈতিক দলও আছে৷ যে সব আঞ্চলিক বা জাতীয় দল কোনও না কোনও রাজ্যে ক্ষমতায় আছে, সেখানে তারাও অঢেল খরচ করে৷ প্রচুর অর্থ দিয়ে ভোট বিশেষজ্ঞ বা তার সংস্থাকে নিয়োগ করে৷ প্রতিটি কেন্দ্রের জন্য ঢালাও খরচ করা হয়৷ তাই, তথ্যের ভিত্তিতে সবমিলিয়ে যে বেশ কয়েক হাজার কোটি টাকা খরচ হয়, এটা ধরে নেওয়াই যায়৷ কিছুটা হলেও, ইলেক্টোরাল বন্ডের সৌজন্যে আজ আমরা প্রত্যেকই এই টাকার উৎস সম্পর্কে অবগত।
এর কতটা প্রভাব অর্থনীতিতে পড়ে? বলে রাখা ভালো, অর্থনীতিও একটা বিষম বস্তু৷ ঘটনা হল, যত অর্থ খরচ হয়, দেশের অর্থনীাতির পক্ষে সবটাই খারাপ তা কিন্তু নয়৷ প্রচুর মানুষ কাজ পাচ্ছেন, কর্মসংস্থান হচ্ছে, বাজারে টাকা আসছে (কিছুক্ষেত্রে হিসাববিহীন)- কেনেসিয়ান মাল্টিপ্লায়ারের প্রভাব সচল। একাধারে এই টাকা যেমন অর্থনীতির গতিপথ চালিত করে তেমনই এর একটি বিরূপ প্রভাব আছে। যেটি হল মুদ্রাস্ফীতি। বলে রাখা ভালো, পুরো অর্থনীতি যে শুধুমাত্র নির্বাচনের উপর ভিত্তি করে চালিত হয়, এমনটা কিন্তু নয়। এছাড়াও, আরও অনেক দিক আছে যেগুলি ক্রমশ আলোচিত হবে। হাতেকলমে প্রভাবটা বোঝার জন্য শেয়ার বাজারের গতিবিধিকে একটি সূচক হিসাবে ধরা যাক। এক্ষেত্রে শেয়ার বাজারের উপরেও নির্বাচনের খরচের সুদূরপ্রসারী প্রভাব আছে।
নির্বাচন ঘনিয়ে আসার সঙ্গে সঙ্গে বিনিয়োগকারীরা রাজনৈতিক উন্নয়ন এবং অর্থনীতিতে তাদের সম্ভাব্য প্রভাব নিবিড়ভাবে পর্যবেক্ষণ করে। সরকারের ব্যবসাপন্থী অবস্থান, “মেক ইন ইন্ডিয়া” এবং পরিকাঠামো উন্নয়নের মতো উদ্যোগের উপর জোর দেওয়া বাজারের জন্য অনুকূল। নির্বাচন-সম্পর্কিত খবর এবং প্রত্যাশার প্রতিক্রিয়ায় ওঠানামা সহ শেয়ার বাজারের অস্থিরতার সময়কালও অনুমান করে। এই বিষয়টি আরও ভালোভাবে বোঝার জন্য, নির্বাচনের তিন মাস আগে এবং পরে শেয়ার বাজারে গতিবিধি কেমন ছিল তা পরিমাপ করতে বিগত কয়েকটি লোকসভা নির্বাচনের সেনসেক্সের পারফরম্যান্সের দিকেও নজর রাখা যেতে পারে।
যেমন, ২০০৯ সালে লোকসভা নির্বাচনের ৩ মাস আগে ৯৭০৯ পয়েন্ট থেকে ১৫৬৬৭ পয়েন্টে গিয়ে দাঁড়ায় সেনসেক্স- পার্থক্যের নিরিখে ৬১.৩ শতাংশ। মজার ব্যাপার হল, ২০১৪ সালে, যেখানে কিনা ২০০৯ সালের তুলনায় নির্বাচনী খরচ অনেকটাই বেড়েছে, শতাংশের হিসাব কমে দাঁড়ায় ১৮.৯ শতাংশ। ২০১৯ সালে আবার পুরো উল্টো। ২০০৪ এবং ২০০৯ -এর নিরিখে ২০১৯ সলে নির্বাচনী খরচ অনেকটাই বেড়ে যায় কিন্তু সেনসেক্স নির্বাচনের ৩ মাস পরে ৩.৫ শতংশ পরে যায় আগের তুলনায়। এর থেকে একটি বিষয় বোঝা যায় যে, নির্বাচনী খরচ বাড়লে শেয়ার বাজারে তার প্রভাব যে সর্বদা ইতিবাচক হবে তা নয়। ইতিপূ্র্বে যেমনটি আলোচিত হয়েছে-নির্বাচনী খরচ একটি দিক মাত্র। ২০১৯-এর যে ফলাফল আলোচিত হয়েছে তাতে জিডিপি বৃদ্ধির হারে পতন, বাজারের কর্মক্ষমতা হ্রাস, বিশ্বব্যাপী অর্থনৈতিক মন্দা এবং মুদ্রাস্ফীতির উচ্চ হার-এগুলিও ছিল গুরুত্বপূর্ণ। এগুলি ছাড়াও, সংখ্যাগরিষ্ঠতার বিচারে সরকারের স্থিতিশীলতা, বিনিয়োগকারীদের মধ্যে আস্থা তৈরী, নীতির ধারাবাহিকতা ও অর্থনৈতিক সংস্কার- এই সকল বিষয়গুলিও সামগ্রিক ভাবে অর্থনীতির উপর নির্বাচনী খরচের প্রভাব নির্ধারণে সহায়ক।
এখন তো মেগার যুগ৷ মেগা মুভি, মেগা শো, মেগা রিলিজ সবই অহরহ দেখতে পাচ্ছি৷ এত বড় দেশের মেগা ভোট এবং অর্থনীতিতে তার প্রভাব দেখার জন্য আমজনতা নিশ্চই মুখিয়ে আছে। (মতামত নিজস্ব)
লেখক সেন্ট জেভিয়ার্স বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনীতির অধ্যাপক
খবরের টাটকা আপডেট পেতে ডাউনলোড করুন সংবাদ প্রতিদিন অ্যাপ
Copyright © 2024 Pratidin Prakashani Pvt. Ltd. All rights reserved.