অধীর চৌধুরী, নওশাদ সিদ্দিকি এবং মহম্মদ সেলিম। ফাইল ছবি।
ধ্রুবজ্যোতি বন্দ্যোপাধ্যায়: জোট যায় যাক, ‘ঐতিহ্যে’র আসন ছাড়ব না। একদিকে শরিক দলের এই গোঁ, আরেকদিক টেনে ধরে রেখেছে বড় শরিক সিপিএম (CPM)। আরএসপি, সিপিআইয়ের থেকে কিছু আসন ‘কেড়ে’ নিয়ে তারা কংগ্রেসকে দিতে চায়, নিজেদের জন্য রাখতে চায় কম সংখ্যক আসনই। আলিমুদ্দিনে বসে এই বাঁদরের পাঁউরুটি ভাগ করতে গিয়ে সব শরিককে একমুখ বকুনিও দিয়ে ফেলেছেন সিপিএমের রাজ্য সম্পাদক মহম্মদ সেলিম (Md Selim)। তাঁর বক্তব্য, শরিকরা বেশি বাড়াবাড়ি করে ফেলছে।
বাংলায় যখন এই অবস্থা, তখন দিল্লিতে সিপিএম-এর মুখাপেক্ষী হয়ে বসে কংগ্রেস প্রথমটায় চেয়েছিল, প্রার্থীহীন একটা তালিকা অন্তত বের করে দেওয়া হোক। তাতে কংগ্রেস যে চুপ করে বসে নেই সেটা অন্তত সামনে আসবে। গত ২৪ ঘণ্টায় সেসবের কোনও দ্বিতীয় আভাস যদিও আর মেলেনি। অন্যদিকে কংগ্রেসের গোঁসা, ফরওয়ার্ড ব্লক কিছু দূরত্বে স্বতন্ত্র থেকে জানিয়ে দিয়েছে তাদের ৩ আসন তারা বামফ্রন্টে থেকেই লড়বে। তাতে কাদের সঙ্গে সিপিএমের ঝগড়া হল, সেসব নিয়ে মাথাব্যথা নেই। এই অবস্থায় আলিমুদ্দিনে বসে সিপিএমের মুখ থেকেও বেরিয়েছে ‘ঐতিহ্যে’র আসন শব্দটি। তাদের প্রলম্বিত বা ‘এক্সটেন্ডেড’ শরিক কংগ্রেসের কাছে সেই শর্তেই দমদম (Dumdum) আসন নিয়ে নিয়েছে সিপিএম। দোহাই দিয়েছে প্রাক্তন মুখ্যমন্ত্রী জ্যোতি বসুর আসন বলে। এদিকে আরেক চিত্র। কলকাতার অদূরে ২-৩টি আসনে ঠেলে রেখে আইসএফকেও (ISF) ছেড়ে দিচ্ছে সিপিএম।
এই সার্বিক জোট চিত্রে অত্যন্ত জটিল হয়েছে বাম-কংগ্রেস-আইসএফ জোট। জট কাটার বদলে তা আরও পেরেছে। কীভাবে? তা বুঝতে গেলে একটু গভীরে যাওয়া দরকার। ফরওয়ার্ড ব্লক, আরএসপি, সিপিআই প্রত্যেকেই ফ্রন্ট শরিক হিসাবে ৩টি আসন চেয়েছিল। ফরওয়ার্ড ব্লক চেয়েছিল কোচবিহার, পুরুলিয়া, বারাসত। সিপিআইয়ের দাবি ছিল বসিরহাট, মেদিনীপুর, ঘাটাল। একমাত্র মেদিনীপুরে তাদের প্রার্থী বিপ্লব ভট্টের নাম ঘোষণা হয়েছে। ঘাটালে তাদের সম্ভাব্য প্রার্থী সৈকত গিরি।
সিপিএমের সঙ্গে বসিরহাট (Basirhat) আসন নিয়ে এই মুহূর্তে তাদের টানাটানি। এই বসিরহাট আসনকেই তাদের ‘ঐতিহ্যে’র আসন বলে দাবি করেছে সিপিআই। কিন্তু সন্দেশখালির ঘটনার পর এই আসন হাতছাড়া করতে নারাজ সিপিএম। এই ঘটনায় তাদের বসিরহাটের প্রাক্তন বিধায়ক নিরাপদ সর্দার গ্রেপ্তারও হয়েছে। ফলে সেই লাভের গুড়ের স্বাদের ভাগ অন্য শরিককে দিতে চায় না সিপিএম। এই আসন পেলে নিরাপদই সেখানে তাদের প্রার্থী। তাঁকে সামনে রেখে বেশ কিছু প্রচারও সেরে ফেলেছে সিপিএম।
এদিকে আরএসসপির আসন আলিপুরদুয়ার, বালুরঘাট আর জয়নগর। প্রথম দুটিতে বামফ্রন্টগতভাবে প্রার্থী দিয়ে রেখেছে তারা। জয়নগর তাদের কাছে চেয়েছে সিপিএম। আরএসপির বক্তব্য, সিপিএম যদি সেখানে দাঁড়ায় তবে কিছুটা নরম তারা হতেও পারে। কিন্তু ওই আসন তারা কোন প্রার্থী দেবে, সেটা আগে জানাতে হবে।
এই অবস্থায় ফরওয়ার্ড ব্লক তাদের কংগ্রেস বিরোধী অবস্থান বজায় রেখে জানিয়ে দিয়েছে কোচবিহার, পুরুলিয়া, বারাসতের কোনও আসনই তারা ছাড়ছে না। কোচবিহারে বামফ্রন্টগতভাবে তারা প্রার্থী দাঁড় করিয়েছে স্কুল শিক্ষক নীতিশচন্দ্র রায়কে। সেখানে ভোট আগে বলে প্রার্থীর নামে পোস্টার তৈরি, প্রচার চলছে। কমিশনেও তথ্য দেওয়া হয়েছে। এই অবস্থায় পুরুলিয়া কংগ্রেসকে ছাড়া হবে বলে কথা দিয়ে রেখেছে সিপিএম। ছাড়া না হলেও সেখানে কংগ্রেসের প্রাক্তন বিধায়ক নেপাল মাহাতো দাঁড়াচ্ছেন। ফরওয়ার্ড ব্লক এই পরিস্থিতি হবে বুঝেই আগেভাগে আসন নিয়ে কংগ্রেসের সঙ্গে সমঝোতা হবে না বলে জানিয়ে প্রস্তাব পাস করিয়ে নিয়েছে কেন্দ্রীয় কমিটির মিটিংয়ে। বাকি ২টি আসনের প্রার্থী তাদের চূড়ান্ত। পুরুলিয়ায় সেখানকার প্রাক্তন বিধায়ক ধীরেন মাহাতোকে তারা টিকিট দিতে চায়। আর বারাসতের টিকিট তারা দিতে চায় স্কুল শিক্ষক প্রবীর ঘোষকে।
এবার তাহলে কী করণীয়? এই জটিল পরিস্থিতিতেই শরিকি আলোচনায় বসে মাথা ঠিক রাখতে পারেননি সিপিএম রাজ্য সম্পাদক মহম্মদ সেলিম। বিশেষ করে ফরওয়ার্ড ব্লকের রাজ্য সম্পাদক নরেন চট্টোপাধ্যায়ের অনড় মনোভাবই তাঁর মুখ দিয়ে বলিয়ে দিয়েছে, “এবার কিন্তু আপনারা বেশি বাড়াবাড়ি করে ফেলছেন।” নরেনবাবুর জবাব ছিল, “কখনওই না। আমরা বামফ্রন্টগত লড়াইয়ে তো সমঝোতা করেই চলছি। ৩ শরিক ৩টি করে আসন চেয়েছি।” প্রসঙ্গত, শরিকদের থেকে ১টি করে আসন নিয়ে কংগ্রেস আর আইসএফের সঙ্গে সমঝোতার আলোচনায় যেতে চেয়েছিল সিপিএম।
আইসএফ এই অবস্থা আঁচ করে আগেভাগে ৮টি আসনে তারা লড়বে বলে ঘোষণা করে দেয়। ফরওয়ার্ড ব্লক ফ্রন্টের বৈঠকে বসে আইসএফকে সঙ্গে নেওয়ায় আপত্তি করেছিল। প্রথমে তাতে চেয়ারম্যান বিমান বসু রাজি হলেও আইসএফ সরাসরি সিপিএমের ভাগে হাত দিতে চায়। ডায়মন্ড হারবারের বদলে যাদবপুরে লড়বে বলে জানায়। সিপিএমের বিপদ বুঝে আবার আইসএফকে সঙ্গে নিয়ে এবার তাদের কলকাতার বাইরেই বেঁধে রাখতে চাইছে। কার্যত বাবা-বাছা করে বুঝিয়েছে যাদবপুর তাদের অনেকদিনের লালিত ‘ঐতিহ্যে’র আসন। সিপিএমের সংস্কৃতি চর্চার আঁতুড়ঘর এই কেন্দ্র। প্রাক্তন মুখ্যমন্ত্রী বুদ্ধদেব ভট্টাচার্যের আসন এটি। সেই আসন ছেড়ে আইসএফ ডায়মন্ড হারবারেই যাক। সঙ্গে তাদের উলুবেড়িয়া আর বারাসত আসন দেওয়া যেতে পারে। তবে এখানেও বিপদ। বারাসত আসন ফরওয়ার্ড ব্লকের। সেই আসনও তারা ছাড়বে না বলে অনড়।
খবরের টাটকা আপডেট পেতে ডাউনলোড করুন সংবাদ প্রতিদিন অ্যাপ
Copyright © 2024 Pratidin Prakashani Pvt. Ltd. All rights reserved.