কোথাও বিচার বিলম্বিত, কোথাও বিচারের বাণী কাঁদে নিভৃতে। আবার কখনও সুবিচার আনে সুসময়। আদালতের এজলাসে অনেক ইতিহাসও তৈরি হয় বছরের পর বছর ধরে। এবছর কী ইতিহাস তৈরি হল.. একনজরে ফিরে দেখল সংবাদ প্রতিদিন ডিজিটাল।
সমকামে বৈধতা: সংবিধানের বিতর্কিত ৩৭৭ ধারাটি নাকচ করে দিল সুপ্রিম কোর্ট। ৬, সেপ্টেম্বর ২০১৮ ভারতের বিচারব্যবস্থার ইতিহাসে ‘রেড লেটার ডে’। এই দিনই বিচারব্যবস্থার উপর আস্থা ফিরে পেয়েছেন দেশের হাজার হাজার সমকামী যুগল। কারণ সুপ্রিম রায়ে বৈধতা পেয়েছিল সমকামিতা। সমলিঙ্গের যৌনতা যে অপরাধ নয়, তা প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল সর্বোচ্চ আদালতের পাঁচ বিচারপতির ডিভিশন বেঞ্চের রায়ে। রায়দানের সময় আদালতের মন্তব্য সংবিধানের ৩৭৭ ধারাটি ছিল দৃশ্যতই অসঙ্গতিপূর্ণ।
আধার আইনে সংশোধনী: আধার কার্ড নিয়ে সরকার বিরোধী টানাপোড়েনের অন্ত নেই। আধার বৈধ নাকি তা গোপনীয়তার অধিকার ভঙ্গ করে এই নিয়েই ছিল মূল তর্ক। এবছর ২৬ সেপ্টেম্বর সেই বিতর্কের অবসান ঘটায় সর্বোচ্চ আদালত। শীর্ষ আদালত জানিয়ে দেয়, আধার সাংবিধানিকভাবে বৈধ, প্রান্তিক কিছু প্রকল্পের জন্য আধারের প্রয়োজন। কিন্তু একই সঙ্গে আধার আইনের ৫৭ নং ধারাটি বাতিল করে শীর্ষ আদালতের ৩ সদস্যের ডিভিশন বেঞ্চ। যার ফলে ব্যাংক অ্যাকাউন্টের সঙ্গে আধার সংযুক্তিকরণ, মোবাইল বা সিম কার্ডের সঙ্গে আধার সংযুক্তিকরণের কোনও প্রয়োজন নেই। তবে, প্যান কার্ডের সঙ্গে আধার সংযুক্তিকরণ বাধ্যতামূলক রইল।
সবরীমালায় মহিলাদের প্রবেশাধিকার: ধর্মের নামে লিঙ্গ বৈষম্যকে বরদাস্ত করা যাবে না। সবরীমালা মন্দিরে মহিলাদের প্রবেশাধিকার নিয়ে ঐতিহাসিক রায় দিয়ে এমনিই মন্তব্য করে সুপ্রিম কোর্ট। সুপ্রিম কোর্টের রায়ের ফলে দশকের পর দশক ধরে চলে আশা নিষেধাজ্ঞা শেষ হয়। সবরীমালা মন্দিরে প্রবেশাধিকার পান ১০ থেকে ৫০ বছর বয়সী মেয়েরাও। রায়দানের সময় প্রধান বিচারপতি মন্তব্য করেন “সবরীমালা মন্দিরে চলে আসা এই প্রথা হিন্দু মহিলাদের মৌলিক অধিকার হরণ করে।” যদিও, শীর্ষ আদালতের রায়ের পর কেরলের পরিস্থিতি উত্তপ্ত হয়ে ওঠে। রায়ের তীব্র বিরোধিতা করে কেরলের আয়াপ্পা ভক্তরা। ঘটনা হিংসাত্মক রূপ নেয়, গ্রেপ্তার করা হয় হাজার হাজার আয়াপ্পা ভক্তকে। কিন্তু তাতেও শেষ পর্যন্ত এখনও কোনও মহিলা সবরীমালায় প্রবেশ করতে পারেননি।
পরকীয়া বৈধ: পরকীয়া অবরাধ নয়। ২০১৮-র অন্যতম চর্চিত রায় সুপ্রিম কোর্টের। প্রায় ১৫০ বছরের পুরনো আইন বদলে সর্বোচ্চ আদালতের রায় পরকীয়া সম্পর্কের জন্য কোনও আইনি পদক্ষেপ করা যাবে না। সর্বোচ্চ আদালতের পর্যবেক্ষণ, কোনও নারীকে পুরুষ তাঁর ব্যক্তিগত সম্পত্তি হিসেবে ব্যবহার করতে পারবেন না। আদালতের মতে, পরকীয়া আইনের ৪৯৭ নং ধারাটি লিঙ্গ বৈষম্যকে উৎসাহিত করে। নারী-পুরুষের সমানাধিকার প্রতিষ্ঠার জন্যই দেওয়া হয় এই রায়।
আদালতের কাজ লাইভ স্ট্রিমিং: এবার আদালতের কার্যবিবরণী সরাসরি দেখা যাবে অনলাইন বা টিভির পর্দায়। ঐতিহাসিক রায়ে জানিয়ে দিল সর্বোচ্চ আদালত। প্রধান বিচারপতি দীপক মিশ্রর নেতৃত্বাধীন ডিভিশন বেঞ্চ এই সংক্রান্ত একাধিক জনস্বার্থ মামলার ভিত্তিতে এই রায় দেন।রায়দানের সময় আদালতের পর্যবেক্ষণ, মানুষকে আদালতের ভিতরে কী হচ্ছে তা সঙ্গে সঙ্গে জানতে দিন। আদালত কক্ষে কী হচ্ছে তা সাধারণ মানুষেরও জানা উচিত। আদালতের মতে, লাইভ স্ট্রিমিং হলে বিচারব্যবস্থায় আরও স্বচ্ছতা আসবে এবং তা জনস্বার্থে কাজে লাগবে।
অযোধ্যা মামলা: দীর্ঘদিনের বিতর্কিত অযোধ্যা মামলার দ্রুত রায়দানের আবেদন করেছিল উত্তরপ্রদেশ সরকার-সহ বেশ কয়েকটি সংগঠন। কিন্তু, সেই আবেদন নাকচ করে দেয় সর্বোচ্চ আদালত। বিচারপতিরা সাফ জানিয়ে দেন, আদালতের নিজস্ব পছন্দ আছে, সেই পছন্দের ভিত্তিতেই মামলার রায়দান হবে। ২০১৯-এর জানুয়ারিতে আদালত নির্দেশিত ডিভিশন বেঞ্চই ঠিক করবে কবে অযোধ্যা মামলার চূড়ান্ত শুনানি হবে। সুপ্রিম কোর্টের এই সিদ্ধান্ত বিজেপি তথা হিন্দুত্ববাদী সংগঠনগুলির জন্য বড় ধাক্কা। কারণ ২০১৯-নির্বাচনের আগে মন্দির নির্মাণের আশায় কার্যত জল পড়ে গেল।
নমাজের জন্য মসজিদ অপরিহার্য নয়: নমাজ পড়ার জন্য মসজিদ বাধ্যতামূলক নয়। অযোধ্যা মামলা নিয়ে বিতর্কের মধ্যেই রায় দেয় সর্বোচ্চ আদালতের তিন সদস্যের ডিভিশন বেঞ্চ। প্রধান বিচারপতির নেতৃত্বাধীন বেঞ্চ জানিয়ে দিল, উপাসনার জন্য মসজিদ অপরিহার্য নয়। নমাজ ইসলামের অপরিহার্য অংশ। যে কোনও ধর্মেই উপাসনা এবং উপাসনাস্থল দুটিই গুরুত্বপূর্ণ। কিন্তু কেন্দ্র চাইলে রাষ্ট্রের প্রয়োজনে মসজিদের জমি অধিগ্রহণও করতে পারবে। শুধু মসজিদের ক্ষেত্রে নয়, মন্দির বা চার্চের ক্ষেত্রেও এই রায় প্রযোজ্য। এই রায়ের ফলে অযোধ্যায় মন্দির নির্মাণের রাস্তা খুলে যাবে বলে ধারনা অনেকের।
পর্ন ওয়েবসাইট বন্ধ: না সুপ্রিম কোর্ট নয়, এই নির্দেশিকাটি দিয়েছিল উত্তরাখণ্ড হাই কোর্ট। দেশজুড়ে মোট ৮২৭টি পর্ন সাইট বন্ধের নির্দেশ দেই উত্তরাখণ্ডের আদালতটি। এর জেরেই দেশজুড়ে পর্ন সাইট বন্ধ করা শুরু করেছে টেলিকম সংস্থাগুলি।
শিক্ষক নিয়োগে জটিলতা কাটল: রাজ্যের শিক্ষক নিয়োগ নিয়ে জটিলতা কাটল। উচ্চ প্রাথমিক, মাধ্যমিক এবং উচ্চমাধ্যমিক স্তরে শিক্ষক নিয়োগের উপর থেকে অন্তর্বর্তী স্থগিতাদেশ প্রত্যাহার করে নিল হাই কোর্ট। এর ফলে ২০১৬-য় যে টেট হয়েছিল, সরকার চাইলে সেই পরীক্ষার ভিত্তিতে নিয়োগ করতে পারবে।
ডিএ আইনি অধিকার: মহার্ঘ্য ভাতা বা ডিএ সরকারি কর্মীদের ন্যায্য আইনি অধিকার। এটা সরকারের দয়ার দান নয়। ১৭ মাস ধরে শুনানির পর ৩১ আগস্ট এই রায় জানিয়ে দেয় কলকাতা হাই কোর্ট। এর ফলে রাজ্যের সরকারি কর্মীদের মহার্য্য ভাতার অধিকার স্বীকৃত হয়।
অলঙ্করণ: সুযোগ বন্দ্যোপাধ্যায়
খবরের টাটকা আপডেট পেতে ডাউনলোড করুন সংবাদ প্রতিদিন অ্যাপ
Copyright © 2024 Pratidin Prakashani Pvt. Ltd. All rights reserved.